হার্ট অ্যাটাক একটি জীবন-মরণ পরিস্থিতি, যা, যে কারও জীবনে আসতে পারে। তবে ভয় পাবেন না। সচেতন থাকা আর সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে অনেক বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব। আসুন, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যপারে বিস্তারিত জেনে নিই।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হলো তীব্র বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, এবং বমি ভাব। এরকম হলে দ্রুত রোগীকে আরামদায়ক অবস্থানে বসান বা শোয়ান। অ্যালার্জি না থাকলে একটি অ্যাসপিরিন চিবিয়ে খেতে দিন। শ্বাস বন্ধ হলে সিপিআর দিন এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।
এবার আসুন হার্ট অ্যাটাক এর লক্ষণ, প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত জানি। মনে রাখবেন, যে কোনো রোগের বিষয়ে আপনার সঠিক জ্ঞান রোগের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীর জীবন বাঁচাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে অনেক সময় সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা কঠিন হয়, কারণ সবাই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন নন। লক্ষণগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে সঠিক সময়ে সাহায্য করা সম্ভব হয়, যা একজনের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হলো:
চ্যানেল ২৪ এর "সুরক্ষায় প্রতিদিন" অনুষ্ঠানে প্রফেসর ডাক্তার মইনুদ্দিন আহমদ, সিনিয়র কনসাল্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজি, ইউনিকো হসপিটালস বলেন, “হার্ট অ্যাটাকের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র বুকে ব্যথা, যা অনেক সময় গলা, পেট বা দুই হাতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর ঘাম হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, মাথা ঘোরা বা দুর্বল বোধ করা, এবং শ্বাসকষ্ট।”
উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবহেলা করবেন না। বিশেষ করে বুকে ব্যথা, শ্বাসের কষ্ট বা ঘাম হলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। নিজের এবং প্রিয়জনের সুস্থতার জন্য এই লক্ষণগুলো ভালো করে মনে রাখুন।
তবে ডাক্তারের কাছে নেয়ার আগে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রুগীকে রক্ষা করতে পারে। চলুন জেনে নেই হার্ট অ্যাটাকের কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে জীবন-মৃত্যুর মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে এটি প্রবাদ প্রচলিত আছে - “এভ্রি সেকেন্ডস কাউন্ট।” তাই হার্ট অ্যাটাক হলে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রথমিক চিকিৎসার সহজ ধাপগুলো জানা থাকলে বিপদের মুহূর্তে দ্রুত সাহায্য করা সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাকের মতো জরুরি অবস্থায় কীভাবে রোগীকে সান্ত্বনা দেবেন, কী করবেন এবং কী করবেন না—এসব জানা আপনাকে পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করবে। সচেতনতাই জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি। প্রফেসর ডাক্তার মইনুদ্দিন আহমদ আরো বলেন:
যখন বুঝবেন কেউ হার্ট অ্যাটাক করছে, দেরি না করে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করুন। নিচে প্রাথমিক চিকিৎসার ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো।
প্রথমেই নিজেকে শান্ত রাখুন। আপনার আতঙ্ক রোগীর অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। রোগীকে একটি আরামদায়ক জায়গায় বসান বা শুইয়ে দিন। মাথার নিচে নরম কিছু দিয়ে তাকে স্বস্তিদায়কভাবে অবস্থান করান। যদি রোগী হাঁপায় বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাহলে তার কাঁধ ও ঘাড় সামান্য উঁচু করে দিন। ভুল করেও তাকে কোনো ধরনের ভারী কাজ করতে বলবেন না এবং তাড়াহুড়ো করবেন না। ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামলান।
সম্ভব হলে তৎক্ষণাৎ ৯৯৯ এ ফোন করুন। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর আগেই কাছাকাছি পেশাদার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন। যদি অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হয়, এবং পাশে কেউ পরিচিত থাকেন, তাহলে দ্রুত ও নিরাপদভাবে ব্যক্তিগত যানবাহনে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। রোগীর অবস্থা যদি দ্রুত খারাপ হতে থাকে, তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে চিকিৎসকদের কাছ থেকে জরুরি সহায়তা নেওয়াই জীবন রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
যদি রোগীর অ্যাসপিরিনে অ্যালার্জি না থাকে, তাহলে তাকে একটি অ্যাসপিরিন বড়ি খেতে দিন। চিবিয়ে খাওয়ানো অধিক কার্যকর, কারণ এটি দ্রুত রক্তে মিশে কাজ শুরু করে। অ্যাসপিরিন রক্ত জমাট বাঁধা কমাতে সহায়তা করে, যা হার্টে রক্ত প্রবাহ কিছুটা স্বাভাবিক রাখতে পারে। তবে, রোগী যদি আগে থেকে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণের নির্দেশনা পান, তাহলে অ্যাসপিরিন দেওয়ার আগে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
রোগীর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে বা সে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়লে, এক মুহূর্তও দেরি না করে CPR দেয়া শুরু করুন। কিভাবে CPR দিবেন জানতে হলে, ছোট এই ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন।
দুই হাত দিয়ে বুকের মাঝখানে টানা চাপ দিন — প্রতি মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার চাপ দেওয়ার মতো একটি নিয়মিত ছন্দ বজায় রাখুন। যদি আপনার CPR পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকে, তবে তা অনুসরণ করুন। এটি রোগীর মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ চালু রাখতে সাহায্য করে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পাওয়া অবস্থায়ও তার রোগীর প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পালন করে।
আপনার কাছে যদি অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে, তবে দ্রুত রোগীর কাছে পৌঁছান, এবং অক্সিজেন দিন। এতে রোগীর শ্বাস নেওয়া কিছুটা সহজ হবে। এটি তার হার্টের ওপর চাপ কমায়, শরীরের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে, সিলিন্ডার ব্যবহারে সতর্ক থাকুন এবং রোগীর অবস্থা মনিটর করুন।
এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে হার্ট অ্যাটাকের সময় রোগীকে জরুরি চিকিৎসার আগ পর্যন্ত সামলানো সম্ভব মনে রাখবেন, আপনার দ্রুত ও সচেতন পদক্ষেপই একজনের জীবন বাঁচাতে গুরুত্তপুর্ন ভূমিকা পালন করবে ।
হার্ট অ্যাটাকের সময় দ্রুত পদক্ষেপের পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি। কিছু ভুল পদক্ষেপ রোগীর অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে। তাই এই ধরনের পরিস্থিতিতে কী কী এড়িয়ে চলা উচিত, তা জানা খুবই জরুরি। প্রতিটি বিষয় নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
হার্ট অ্যাটাকের সময় রোগীকে কখনো একা ছেড়ে যাবেন না। তার পাশে থেকে তাকে সাহস যোগান এবং পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করুন। একা থাকলে রোগী আতঙ্কে আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই পাশে থাকা জরুরি।
রোগীকে নিজের মতো করে কোনো বড় ওষুধ খাওয়ানো বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ দেওয়া কখনোই উচিত নয়। ভুল ওষুধ রোগীর অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের সময় রোগীকে বিশ্রামে রাখাই বেশি নিরাপদ। তাকে চলাফেরা বা শারীরিক কাজ করতে বলবেন না। অপ্রয়োজনীয় শারীরিক কাজ তার হার্টের উপর আরও চাপ ফেলতে পারে। এটি তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কিছু মানুষ হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোকে সাধারণ ব্যথা ভেবে এড়িয়ে যান। এটি একটি মারাত্মক ভুল। শরীরে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলে তা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। যত দ্রুত সম্ভব একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এই বিষয়গুলো মনে রেখে আপনি হার্ট অ্যাটাকের সময় আরও কার্যকরভাবে রোগীর পাশে থাকতে পারবেন। প্রতিটি পদক্ষেপই জীবন বাঁচাতে পারে। সতর্ক থাকুন এবং রোগীকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করুন।
“প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।”
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে, প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট হাঁটুন অথবা ব্যায়াম করুন এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন। ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন এবং মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিশেষ করে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। সচল জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। [সূত্র: সুরক্ষায় প্রতিদিন, চ্যানেল ২৪]
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আপনি জীবনযাত্রায় সচেতন পরিবর্তন আনেন। কিছু অভ্যাস রয়েছে যেগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। আপনার দৈনন্দিন জীবনে কিছু সঠিক পরিবর্তন নিয়ে আনতে পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই এড়িয়ে চলা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু একটু সচেতনতা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। নিচে কতগুলি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বিস্তারিত দেয়া হলো।
সতর্ক জীবনযাপন এবং সঠিক অভ্যাস গড়ে তুললে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা যায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন আপনার হার্টকে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে। নিজের এবং পরিবারের প্রতি যত্নশীল হন এবং সুস্থ জীবন উপভোগ করুন। সচেতনতা ও নিয়মিত যত্নই হৃদরোগ প্রতিরোধের চাবিকাঠি।
হার্ট অ্যাটাকের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা জানলে আপনি কারও জীবন বাঁচাতে পারেন। লক্ষণগুলো দ্রুত চিহ্নিত করুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন, সময়মতো চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগই অনেক বড় ঝুঁকি কমাতে পারে। সচেতন থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।