unico hospital

News
2025-08-10

স্ট্রোক হলে কী করবেন?

Go Back

Contact Contact

স্ট্রোক এমন একটি স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা, যা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে প্রাণঘাতী হতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বাধা পড়ে, দ্রুত সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেলে এটি দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতা বা মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। তাই স্ট্রোকের লক্ষণ চেনা এবং স্ট্রোক হলে কী করণীয়, সেগুলো জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

স্ট্রোকের লক্ষণ চেনার উপায় 

স্ট্রোকের লক্ষণগুলো বুঝতে পারলে সময়মতো রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব । নিচে স্ট্রোকের প্রধান লক্ষণগুলো দেওয়া হলো:

  • মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়া: রোগীর হাসি পরীক্ষা করুন। মুখের এক পাশ বাঁকা হয়ে গেলে সতর্ক হোন।
  • হাত বা পায়ের দুর্বলতা: রোগীকে দুই হাত তুলতে বলুন। এক হাত কাজ না করলে এটি স্ট্রোকের সংকেত হতে পারে।
  • কথা জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্টতা: কথা বলতে কষ্ট হওয়া বা বোঝা না গেলে দ্রুত পদক্ষেপ নিন।
  • চোখে ঝাপসা দেখা বা অন্ধকার দেখা: যেকোনো চোখের দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • তীব্র মাথাব্যথা: বাজ পড়ার মতো মাথাব্যথা অনুভূত হলে সতর্ক হতে হবে।

স্ট্রোক শনাক্ত করার একটি সহজ নিয়ম হলো FAST । নিম্নলিখিত লক্ষণগুলির মধ্যে যে কোন একটি দেখতে পেলে, রোগীকে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যান।

  • F (Face) মানে, মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়া 
  • A (Arm) মানে, একটি হাত বা পা দুর্বল বা অবশ হয়ে পড়া 
  • S (Speech) মানে, অস্পষ্ঠ অথবা কথা জড়িয়ে যাওয়া  
  • T (Time) মানে, সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া ।

স্ট্রোক হলে তৎক্ষণাৎ কি করবেন?



স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হয়। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে মারাত্মক ক্ষতি এড়ানো সম্বভ। নিচে কী কী করতে হবে সেগুলো ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো।

১। অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন

স্ট্রোকের লক্ষণ বুঝতে পারলেই দেরি না করে অবিলম্বে জরুরি সেবা নিতে হবে। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। এই ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীকে নিজস্ব পরিবহনে নেওয়ার চেষ্টায় সময় নষ্ট হতে পারে এবং ঝুঁকি বাড়তে পারে। চিকিৎসক কিংবা পেশাদার সেবাদানকারী যত দ্রুত পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিবে, ততই রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

২। রোগীকে স্থির রাখুন

রোগী যেন নিশ্চিন্তভাবে শুয়ে থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করুন। তাকে কোনোভাবেই চলাফেরা করতে দেবেন না। রোগীর মাথা সামান্য উঁচুতে রাখুন এবং আশেপাশে ছোটাছুটি কিংবা উত্তেজনা তৈরি করবেন না। আঘাতের ঝুঁকি কমাতে রোগীকে একটি আরামদায়ক স্থানে রাখতে হবে।

৩। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিশ্চিত করুন

রোগী যদি শ্বাস নিতে কষ্ট পায়, তবে তাকে পাশে কাত করে শুইয়ে দিন। মুখ থেকে লালা, বমি কিংবা অন্য কোনো কিছু বের হলে তা পরিষ্কার করুন, যেন শ্বাস নিতে ব্যাঘাত না ঘটে।  এ ক্ষেত্রে রোগীর জন্য যথেষ্ট জায়গা ও তাজা বাতাস নিশ্চিত করাও জরুরি।

৪। কিছু খেতে দেবেন না

কোনো অবস্থাতেই রোগীকে খাবার বা পানি দেবেন না। খাবার গলায় আটকে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া স্ট্রোকের ধরন ভেদে ভিন্ন চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। তাই খাবার বা পানীয় রোগীর অবস্থাকে জটিল করতে পারে।

৫। শান্ত থাকুন এবং মনোযোগী হয়ে কাজ করুন

রোগীর আশেপাশে কখনোই ভিড় বাড়ানো যাবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখতে হবে এবং দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি নিজে ধীরস্থির থাকলে রোগীর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। ভিড়ে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যাও বাড়ার আশঙ্কা থাকে।

উপরে উল্লেখিত কাজগুলো সময়মতো করতে পারলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।

স্ট্রোকের কারণসমূহ

স্ট্রোক সাধারণত মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ঘটে। তবে যে সকল কারণে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় তা এড়িয়ে চলতে পারলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। নিচে স্ট্রোক হওয়ার কিছু প্রধান কারণ দেয়া হলো:

  • অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ। 
  • ডায়াবেটিস। 
  • রক্তে অতিরিক্ত চর্বি বা কোলেস্টেরল। 
  • ধূমপান এবং মাদক সেবন। 
  • দীর্ঘদিন শারীরিক অকর্মণ্যতা। 
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ।

উপরের কারণগুলো একসঙ্গে অথবা পৃথকভাবে স্ট্রোকের কারণ হিসেবে কাজ করে। জীবনযাত্রার প্রতি সতর্ক থাকলে এসব ঝুঁকি অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং মানসিক চাপ কমাতে পারলে, স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশেই হ্রাস পায়।

স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়

স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব যদি আমরা কিছু নিয়ম মেনে চলি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত শরীরচর্চা স্ট্রোক প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।

নিচে স্ট্রোক প্রতিরোধের বেশ কিছু কার্যকরী উপায় দেয়া হলোঃ

  • রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করুন। 
  • পুষ্টিকর খাবার খান এবং ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলুন। 
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকুন। 
  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। 
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। 
  • মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন বা রিল্যাক্সেশন পদ্ধতি অনুসরণ করুন।

জীবনের প্রতি একটু যত্নশীল হওয়া এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলাই স্ট্রোক প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। প্রতিটি ছোট ছোট পদক্ষেপ আপনাকে বড় সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।

স্ট্রোকের চিকিৎসা পদ্ধতিঃ  সময়ের গুরুত্ব ও ধাপ  

স্ট্রোকের ক্ষেত্রে 'সময়' একটি বড় ভূমিকা পালন করে। লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে প্রথম চার ঘণ্টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করলে মস্তিষ্কের কোষে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কমে। চিকিৎসকেরা এই সময়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে, যদি স্ট্রোক রক্তনালির ব্লকের কারণে হয়, তবে এই সময়কালের মধ্যেই সঠিক চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। তবে, কোনো অবস্থাতেই দেরি করা উচিত নয়, কারণ সময় যত গড়াবে, মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি তত বাড়তে থাকবে।

গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও চিকিৎসা পদ্ধতি

স্ট্রোকের চিকিৎসায় কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া হলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সুযোগ অনেকগুণ বেড়ে যায়। সাধারণত চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা বুঝে নিচের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন।


  • থ্রম্বোলাইসিস থেরাপি: এই পদ্ধতিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিশেষ ওষুধ দেওয়া হয়, যা রক্তনালির ব্লক সরিয়ে দেয়। এতে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল পুনরায় স্বাভাবিক হয় এবং রোগীর সুস্থতার সম্ভাবনা বাড়ে। 
  • ডিকম্প্রেসিভ ক্র্যানিওটমি অস্ত্রোপচার: জটিল স্ট্রোকের ক্ষেত্রে, যখন মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্তপাত হয়, তখন এই শল্যচিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। এতে মস্তিষ্কের চাপ কমিয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা হ্রাস করা হয়।
  • মেকানিক্যাল থ্রম্বেকটমি: ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে এই চিকিৎসা দেওয়া যায়। ক্যাথেটার নামক বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণ করা হয়।

সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে। চার ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলে, মস্তিষ্কের কোষের ক্ষয় অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। তবে চার ঘণ্টার পরেও চিকিৎসার গুরুত্ব রয়েই যায়। বিলম্বিত হলেও কিছু বিশেষ পদ্ধতি স্ট্রোক রোগীদের ফাংশনাল রিকভারি করতে সহায়তা করতে পারে। রোগীদের প্রতি সময়মতো মনোযোগ এবং সচেতন সিদ্ধান্তই রোগীর জীবনরক্ষার চাবিকাঠি।

তাই স্ট্রোক হলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। লক্ষণগুলো চিনুন, দ্রুত ব্যবস্থা নিন এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ছাড়া সচেতন জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিজের প্রতি এবং প্রিয়জনদের প্রতি সজাগ থাকুন, কারণ সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়াই জীবন বাঁচাতে পারে।